আজ ১০ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) বিশ্ব বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের শততম জন্মদিন। ১৯২৪ সালের এদিন তিনি নড়াইল মহাকুমার মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তার বাবা মেছের আলী পেশায় ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। মা মাজু বিবি একজন গৃহিণী।
এ বছর থেকে মহান এই শিল্পীর জন্মশতবর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিল্পকলা একাডেমী।
এস এম সুলতান ১৯২৮ সালে নড়াইল আশ্রম স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। স্কুলের অবসরে বাবাকে কাজে সহযোগিতা করার সময় ছবি আঁকতে শুরু করেন। ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়াকালীন ১৯৩৩ সালের কোনো একদিন রাজনীতিক ও জমিদার শ্যামাপ্রাসাদ মুখোপাধ্যায় নড়াইলের জমিদার ব্যারিস্টার ধীরেন রায়ের আমন্ত্রণে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে গেলে তার একটি পোট্রেট আঁকেন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র এস এম সুলতান। মুগ্ধ হন শ্যামাপ্রাসাদসহ অন্যরা। তারা তাকে কলকাতায় আমন্ত্রণ জানান। এরপর লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ১৯৩৮ সালে কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা ও জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন তিনি।
সে সময় চিত্র সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি তাকে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি করাতে গেলে বাধ সাধে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান সুলতান।
নড়াইলের লাল মিয়া কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই ডাক নাম ছেড়ে এস এম সুলতান নামে পরিচিত হতে থাকেন।
১৯৪৩ সালে আর্ট স্কুল ত্যাগ করে ঘুরে বেড়ান এখানে-সেখানে। এ সময় কাশ্মীরের পাহাড়ে উপজাতীয়দের সঙ্গে বসবাস এবং জীবন-জীবিকা নিয়ে চিত্রাঙ্কন শুরু করেন।
১৯৪৫ সালে ভারতের সিমলায় তার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে লাহোরে সুলতানের চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। ১৯৫০ সালে আমেরিকাতে চিত্রশিল্পীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন এস এম সুলতান।
এরপর ইউরোপের বেশ কয়েকটি একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, পল ক্লী প্রমুখ খ্যাতিমান শিল্পীদের ছবির পাশে সুলতানই এশিয়ার একমাত্র শিল্পী যার ছবি এসব প্রদর্শনীতে সুযোগ লাভ করে।
১৯৫৩ সালে নড়াইলে ফিরে আসেন সুলতান। শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চারুকলা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই ‘দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় ‘শিশুস্বর্গ’।
শিশুদের খুবই ভালোবাসতেন এই বহেমিয়ান। তাইতো শিশুদের নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে চিত্রা নদীতে ঘুরে ছবি আকার জন্য তার সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ১৯৯২ সালে ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট দ্বিতলা নৌকা (ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ) নির্মাণ করিয়েছিলেন।
চিত্রশিল্পের ইতিহাসে এক কিংবদন্তী শিল্প সাধক পুরুষ তার তুলির আঁচড়ে সৃষ্টি করেছেন পাট কাটা, ধানকাটা, ধান ঝাড়া, জলকে চলা, চর দখল, গ্রামের খাল, মৎস্য শিকার, গ্রামের দুপুর, নদী পারাপার, ধান মাড়াই, জমি কর্ষনে যাত্রা, মাছ ধরা, নদীর ঘাটে, ধান ভানা, গুন টানা, ফসল কাটার ক্ষণে, শরতের গ্রামীণ জীবন, শাপলা তোলা’র মত বিখ্যাত সব ছবি। চিত্রাপাড়ের লালমিয়া হয়ে উঠেছেন দেশ জাতির গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। চিত্রাপাড়ের লালমিয়া শিল্পের মূল্যায়ন হিসেবে পেয়েছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার।
এছাড়া ১৯৮২ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা পান। তার চিত্রকর্ম নিয়ে তারেক মাসুদ তৈরি করেন ‘আদমসুরত’।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর অসুস্থ অবস্থায় যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এস এম সুলতান। প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলের কুড়িগ্রামে তাকে শায়িত করা হয়।
ঢাকা,বৃহস্পতিবার ১০ আগষ্ট,এইচ বি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।